মোতাহার হোসেন
প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র এবং স্রোতস্বিনী মেঘনার মিলন স্থলে বিপুল পলল সঞ্চয়ের ফলে গঠিত হয় এক নতুন ভূখণ্ড। যার আদি নাম উলুকান্দির চর এবং জমিদারদের দেয়া নাম ভৈরব। নবগঠিত এই উর্বর ভূখণ্ডে মানব বসতির কাজ শুরু হয় মাত্র কয়েক শতাব্দি আগে। বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে ভাগ্যন্বেষণেই হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক একটি ক্ষত্রীয় ব্রাহ্মণ পরিবারও এ উপজেলার শিমুলকান্দিতে বসতি স্থাপন করে। এই পরিবারটি অন্যান্য পরিবার থেকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিত্ত-চৈতন্যে ভৈরবের অন্যান্য পরিবার থেকে অগ্রগামী ছিল। পরবর্তী সময়ে তারা তালুকদারি ক্রয় করে বেশ বিত্তশালী ধনাঢ্য পরিবার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই প্রতাপশালী তালুকদার পরিবারের অন্যতম সদস্য প্রখ্যাত আইনজীবী হরমোহন বর্মন বিএ বিএল ও মা রুক্ষ্মিণী দেবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে পাঁচ পুত্র ও সাত কন্যা। ছেলের মেয়েদের মধ্যে রেবতী বাবু ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তিনি ১৯০৫ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার শিমুলকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অসাধারণ মেধাবী ছাত্র, ক্ষণজন্মা মার্কসিয় তাত্ত্বিক, লেখক ও বিপ্লবী নেতা ছিলেন রেবতীমোহন বর্মণ।
রত্মগর্ভা মায়ের বড় ছেলে মনমোহন বর্মণ ছিলেন শিমুলকান্দি ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট এবং ঋণসালিসি বোর্ডের চেয়ারম্যান। শেরেবাংলা ঋণসালিসি বোর্ড গঠন করার পর তিনি চেয়ারম্যান হয়ে ঋণগ্রস্ত পরিবারের ভূ-সম্পত্তি ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করেন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং শিমুলকান্দিতে উপস্থিত থেকে মনমোহন বাবুকে পুরস্কৃত করেছিলেন। দ্বিতীয় ছেলে যতীন্দ্র মোহন বর্মণ বাজিতপুর এবং কিশোরগঞ্জের দেওয়ানী আদালতে ওকালতি করতেন। তৃতীয় ছেলে মোহিনীমোহন বর্মণ প্রথমে কুমিল্লার কলেজিয়েট স্কুলে এবং পরে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে অধ্যাপনা করতেন। আর লাল মোহন বর্মণ কলকাতায় চাকরি করতেন। কথিত আছে মোহিনী বর্মণ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। আর কমরেড রেববতী মোহন বর্মণ ছিলেন বিপ্লবী। তিনি শোষণ, নির্যাতন, বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত এক নিবেদিত প্রাণ মহামানব।
লব্দ প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, ভূস্বামী হরমোহন ইংরেজ শাসকদের কৃপায় রায় বাহাদুর খেতাব প্রাপ্ত হয়েছিলেন। নিম্ন প্রাথমিক শিক্ষা তিনি রেবতীমোহনকে অন্যান্য ছেলেদের মতো পারিবারিক পরিবেশেই দিয়েছিলেন। এরপর প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার সরাইলের চুন্টা স্কুলে, ঢাকার পোগোজ ও কলেজিয়েট স্কুলে এবং কুমিল্লা জেলা স্কুলে পড়াশোনা করান।
ঢাকার পোগোজ স্কুলে পড়ার সময় তিনি গভীরভাবে রাজনীতিতে নেশাগ্রস্তের মতো আসক্ত হয়ে পড়েন। বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ, ইংরেজ বিদ্বেষ, পুঁজিবাদদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা এবং বঞ্চিত মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের প্রেষণা তাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে তুলল। রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নেয়ার ফলে ব্রিটিশ পুলিশ তার পিছনে আঠার মতো লেগে থাকে। তখন তাকে বার বার স্কুল পাল্টাতে হয়। এক সময় অবাঞ্ছিত ছাত্র হিসেবে সরকারি স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন। কোন স্কুলেই আর ভর্তি হতে পারেননি। কিন্তু পড়ালেখার প্রতি অদম্য আগ্রহ্য এ বিপ্লবীকে দমাতে পারেননি। তখনকার স্বদেশীয়দের ধারায় পরিচালিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যা ব্রিটিশ শাসকদের প্যারালাল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচালিত হতো। এতেই তিনি ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে তিনি পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। পাশাপাশি কোন সরকার স্বীকৃত স্কুলে ভর্তি হওয়া যায় কিনা তার অনুসন্ধান করছিলেন। পুলিশের হয়রানির কারণে কোন স্কুলই তাকে ভর্তি করতে রাজি হয়নি। স্কুল কর্তৃপক্ষকেও পুলিশ হুমকি দিত এবং এই বলে সতর্ক করতো যে তাকে ভর্তি করলে সরকারি অনুদান বা Grant-in-aid বন্ধ করে দেয়া হবে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের প্রতি তার ঘৃণা আরও বেড়ে গেল। তিনি স্পষ্টই বুঝতে পারলেন ব্রিটিশ সরকার তাকে কোন অবস্থাতেই আর লেখাপড়া করতে দিবে না। অবশেষে তিনি চলে এলেন তার নিজ মহকুমা কিশোরগঞ্জে ভাইয়ের বাসায়। কিশোরগঞ্জে তখন দুটি হাইস্কুল ছিল। একটি স্বনামধন্য রামানন্দ হাই স্কুল অপরটি ১৯১৬ সালে নব্য প্রতিষ্ঠিত আজিম উদ্দিন হাইস্কুল। মহকুমা শহরের সম্ভান্ত পরিবারের মেধাবী ছেলেরা রামানন্দ স্কুলেই পড়তো। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবু নিহার কুমার সেন, এমএ বিটি তিনি গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন পছন্দ করতেন না। তিনি অন্ত্যন্ত স্বনামধন্য শিক্ষক ছিলেন। রেবতীমোহন বর্মণ রামানন্দ স্কুলেই প্রথমে ভর্তি হতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ রাজের অনুগত প্রধান শিক্ষক কোন অবস্থাতেই তাকে ভর্তি করতে রাজি হয়নি। পরে অনেকটা বাধ্য হয়েই নব্য প্রতিষ্ঠিত আজিমুদ্দিন হাই স্কুলে ভর্তি হতে গেলেন। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বসন্ত কুমার চক্রবর্তী ছিলেন ইংরেজ বিদ্বেশী, স্বাধীন চেতা এবং স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। প্রধান শিক্ষক মহোদয় বছরের শেষের দিকে অর্থাৎ পরীক্ষার ঠিক আগ মুহূর্তে ভর্তির কথা শুনে কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলেন। কিন্তু আদ্যোপান্ত শুনে বেদনাহত হন এবং টিসি ছাড়াই ১৯২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ তারিখে ভর্তি করলেন। তবে ভর্তি খাতায় লিখে রাখলেন Provisonally admitted on condition that he would produce the transfer certificate as early as possible. অবশ্য ৫২ দিন পর পোগোজ হাইস্কুল থেকে ৭ নভেম্বর তারিখে টিসি সংগ্রহ করে জমা দিয়েছিলেন। টিসির নম্বর ছিল ৪০। বসন্ত কুমার চক্রবর্তী রেবতীকে ভর্তির সময় একটি শর্ত দিয়েছিলেন। সেটা হলো তাকে অবশ্যই ভালো রেজাল্ট করতে হবে। রেবর্তী তার শিক্ষকের কথা রক্ষা করেছিলেন। তিনি ১৯২২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অবিভক্ত বাংলা, বিহার, ঊড়িষ্যা, আসাম ও বার্মার সব শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এ ধরনের গৌরবোজ্জ্বল ফলাফলে তার শ্রদ্ধাভাজন প্রধান শিক্ষক, স্কুল কর্তৃপক্ষ, প্রতিষ্ঠাতা আজিমুদ্দিন সাহেব এমনকি সমগ্র দেশবাসী বিস্মিত হয়েছিলেন। ঐতিহ্যবাহী রামানন্দ স্কুলে সে বছর ৬১ জন ছাত্র পরীক্ষা দিয়েছিল। এর মধ্যে প্রথম বিভাগে পাস করেছিল ৩০ জন এবং ২য় বিভাগ পেয়েছিল ১৫ জন, কেউ ৩য় বিভাগ পায়নি। তাদের মধ্যে বিনোদ রঞ্জন বিশ্বাস নামে একজন দ্বিতীয় গ্রেডে স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। মাত্র ৭ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত আজিমুদ্দিন স্কুলে এ ধরনের ফলাফলে স্বয়ং প্রধান শিক্ষক অনেকটা বোকাবনে গিয়েছিলেন। ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বিভগে আইয়ে পাস করার পর ১৯২৬ সালে অধ্যাপক কিরণ চন্দ্রের আগ্রহে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই সেন্টপলস্ কলেজে ইংরেজিতে বিএ (অনার্স) ভর্তি হন। অধ্যাপক কিরণ তার পড়াশোনা তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। এই কলেজে পড়ার সময়েই তিনি গ্রেপ্তার হন এবং কারাগার থেকেই পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বিভাগে বিএ পাস করেন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে পুনরায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও ১৯২৯ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে জগত্তারিণী স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। দারিদ্র্যতা পুলিশি ভয়, ব্রিটিশ শাসকদের সার্বক্ষণিক হয়রানিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মেসে থেকে টিউশনি করে এবং গোপন রাজনৈতিক সংগঠনের সব কর্মকাণ্ডের নেতৃত্বে থেকে এই অসাধারণ ফলাফল সত্যিই বিস্ময়ের বিষয়।
কিশোর-যুবকদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্য স্বর্ণপদক বিক্রয় করে তার অর্থ দিয়ে ‘বেণু’ নামে একটি মাসিক দেশাত্মবোধক সাহিত্য পত্রিকা বের করে। ‘বেণুর’ প্রথম সংখ্যায় জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারের দুই সতীর্থ বন্ধু শোভন লাল ও মোহন লাল গঙ্গোপাধ্যায়ের সহযোগে প্রকাশ করলেন রবীন্দ্রনাথে আশীর্বাদের পরিচয় বহন করা এক রচনা।
মধ্যদিনে যবে গান
বন্ধ করে পাখি
হে রাখাল বেণু তব
বাজাও একাকী।
অপরাজেয় কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিপ্রদাস’ উপান্যাসটি তার ‘বেণু’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিশ্বদ্যিালয়ে পড়ার সময় কার্লমার্কস ও লেলিনের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তিনি ১৯২৯ সালে রচনা করেন ‘তরুণ রুশ’ নামে একটি গ্রন্থ। এটিই তার প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ। এরপর আরও ১৭টি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। ভারতীয় সমাজে আর্থসামাজিক-রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও মার্কসীয় তত্ত্বের সমন্বয়ে রচিত অত্যন্ত মূল্যবান গ্রন্থটি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ বেনিয়াদের হস্তগত হয়। তারা এই মূল্যবান গ্রন্থটিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। দীর্ঘ ৮ বছর জেলে থেকে তিনি ৭টি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। সবকয়টি তিনি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯৩৮ সালে প্রকাশ করেন। ১৯৩৯ সালে তার আরও ৪টি, ১৯৪৪ সালে দুটি, ১৯৪৫ সালে ৩টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তার সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সমাজ ও সভ্যতার ক্রম বিকাশ’। বইটি রোগযন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হয়ে নিজ পৈত্রিক ভিটা শিমুলকান্দিতে অবস্থান করার সময় সেখানে বসেই রচনা করেছিলেন। এই অমূল্য গ্রন্থটির রচনা সমাপ্ত করে ১৯৪৬ সালে ন্যাশনাল বুক এজেন্সিকে দিয়ে ছিলেন। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি পুলিশি হয়রানির কারণে দীর্ঘ পাঁচ বছর এই বই প্রকাশ করতে পারেনি। ১৯৫২ সালে ৬ মে রেবতীমোহন দেহত্যাগ করার অল্পদিন (১৯ দিন) পর বইটি প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে ছাত্রদের সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে এটি পড়ানো হয়। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় তিনি জীবদ্ধশায় এ প্রকাশনাটি দেখে যেতে পারলেন না।
জেলে থাকাবস্থায় বন্দী ভাতার টাকা বাঁচিয়ে ইংল্যান্ডের নামকরা প্রকাশনী থেকে ইমপেরিয়াল লাইব্রেরির মাধ্যমে সমাজবিকাশ ও বিবর্তন, মার্কসীয় ও ভাববাদী দর্শনের বই ও জার্নাল সংগ্রহ করতেন। কোম্পানির শাসন আমল থেকে ব্রিটিশ শাসন পর্যন্ত ভারতের ভূমি ব্যবস্থাপনা, ভূমি সংস্কার ইত্যাদি সম্পর্কে যাবতীয় রিপোর্ট, গেজেটেরিয়া সংগ্রহ করে তিনি গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়তেন ও নোট রাখতেন। জেলখানায় তিনি বন্দীদের নিয়ে স্টাডি সার্কেল গড়ে তুলেছিলেন। সংগৃহীত বই পুস্তক তারা গভীরভাবে অধ্যায়ন করতেন এবং সহপাঠী বন্দীদের সঙ্গে এ সম্পর্কে আলোচনা ও মতবিনিময় করতেন। তিনি জেলের ভিতর সংহতি ও The communist নামে হাতের লেখা বাংলা ও ইংরেজি দুটি পত্রিকা বের করতেন এবং ভারতবর্ষে আর্থসামাজিক অবস্থা, বৈষম্য, নিপীড়ন ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে মুক্তির সনদ হিসেবেই তিনি রচনা করেছিলেন ১৮টি বই ও দুটি পুস্তিকা। বই লিখতে গিয়ে কিছু শব্দের পারিভাষিক শব্দ নিয়ে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত হলে ১৯৩২ সালে ৫ জানুয়ারি সিউড়ির জেল থেকে রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতনের ঠিকানায় নিম্নোক্ত পত্রটি পাঠিয়েছিলেন।
পরম পূজনীয় শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পরম পূজনীয়েসু,
রাষ্ট্রনীতি নিয়ে বাংলায় একখানা গ্রন্থ তৈয়ারী করিতে শুরু করিয়া পরিভাষার খুবই অসুবিধা ভোগ করিতেছি Nationalism কে জাতীয়তা ও Nation কে জাতি বলিয়া চালানো কি উচিৎ। শ্রদ্ধাসম্পদ শ্রীযুক্ত যোগেশ বিদ্যানিধি মহাশয় Nationalism কে রাষ্ট্রিক ও Nation কে রাষ্ট্র, জন, রাষ্ট্রজ এই তিনটি প্রতিশব্দ দিয়ে চালাইতে চাহিয়াছেন, কিন্তু এ বিষয়ে আমার সংশয় রহিয়া গিয়াছে। আশা করি আপনার উপদেশ পাইয়া সংশয়যুক্ত হইব। আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম ও অশেষ শ্রদ্ধা জানিবেন।
একান্ত অনুগত
শ্রী রেবতী বর্মণ।
রবীন্দ্রনাথ পত্র পাওয়া মাত্রই জবাব দিয়েছিলেন।
কল্যাণীয়েষু,
আমার মনে হয়, নেশন, ন্যাশনাল প্রভৃতিশব্দ ইংরেজিতে রাখা ভালো- যেমন অক্সিজেন, হাইড্রোজেন। ওর প্রতিশব্দ বাংলায় নেই। ‘রাষ্ট্রজন’ কথাটা চালানো যেতে পারে। রাষ্ট্রজনিক এবং রাষ্ট্রজনিকতা শুনিতে খারাপ হয় না। আমার মনে হয় রাষ্ট্রজনের চেয়ে রাষ্ট্রজাতি সহজ হয়। কারণ, নেশন অর্থে জাতি শব্দের ব্যবহার বহুল পরিমানে চলে গেছে। সেই কারণেই রাষ্ট্রজাতি কথাটা কানে অত্যন্ত নতুন ঠেকবে না। Caste জাতি, Race জাতি, Nation রাষ্ট্রজাতি, People জনসমূহ, Population প্রজন।
২২শে জানুয়ারি, ১৯৩২
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৯৩৯ সালে কমরেড মোজাফফর আহমদ ও তার সতীর্থদের নিয়ে কোলকাতায় সোসালিস্ট প্রকাশনী সংস্থা ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’ প্রতিষ্ঠা করেন। নেপাল নাগ, গোপাল বসাক ও জ্ঞান চক্রবর্তীর সহায়তায় ঢাকায় মার্কসবাদী পুস্তক প্রকাশনার জন্য ঢাকা ‘গণ সাহিত্য চক্র’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থার সৃষ্টি করেন। নিচে তার বইগুলোর একটি তালিকা দেয়া হলো। ১। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি (১৯৩৮), ২। মার্কস প্রবেশিকা (১৯৩৮), ৩। কৃষক ও জমিদার (১৯৩৮), ৪। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্কট (১৯৩৮), ৫। হেগেল ও মার্কস্ (১৯৩৮), ৬। ক্যাপিটাল (মার্কস এর ক্যাপিটালের বাংলায় লেখা সংক্ষিপ্ত সার) (১৯৩৮) ৭। ভারতে কৃষকের সংগ্রাম ও আন্দোলন (১৯৩৮), ৮। লেনিন ও বল্শেভিক পার্টি (১৯৩৯), ৯। Society and Its Development (১৯৩৯), ১০। | Marxist Viwe of Capital (১৯৩৯), ১১। সমাজের বিকাশ, (১৯৩৯), ১২। সোভিয়েট ইউনিয়ন (১৯৪৪), ১৩। শান্তিকামী সোভিয়েট (১৯৪৪), ১৪। অর্থনীতির গোড়ার কথা (১৯৪৫), ১৫। পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি (বাংলা তরজমা), ১৬। সমাজতন্ত্রবাদ- বৈজ্ঞানিক ও কাল্পনিক (বাংলা তরজমা), ১৭। সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ (১৯৫২), ১৮। তরুণ রুশ (১৯২৯)।
ভৈরবের এক নিভৃত পল্লীতে সম্ভান্ত ক্ষত্রীয় তালুকদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রেবর্তী মোহন বর্মণ। বাবা অ্যাডভোকেট হরমোহন বর্মণ রায় বাহাদুর ছেলেকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলার জন্য প্রথমে সরাইলের চুন্টায় পরে ঢাকার পোগোজ স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। বুর্জোয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও অসাধারণ মেধাবী এই তরুণের মধ্যে শ্রেণী বৈষম্য, বর্ণবিরোধ ছিল না। বরং ইংরেজদের শোষণ, বঞ্চনা, দারুণভাবে ছেলেবেলা থেকেই তার হৃদয়ে রেখাপাত করেছিল। যোগ দিয়েছিলেন গান্ধীজির অসযোগ আন্দোলনে এবং শ্রী সঙ্গে। ১৯২৩ থেকে ১৯২৪ সালে তিনি বেঙ্গল বলান্টিয়ারের কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯২৭ থেকে ১৯২৮ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এই জাগ্রত তরুণ আগ্নেয়গিরির মতই জ্বলে উঠেছিলেন। মেধাবী এই তরুণ ইচ্ছা করলে আইসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি আমলা হতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। কলকাতা, বাকুরা ও বীরভূমে তিনি বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৩০ সালে সূর্যসেনের নেতৃত্বে অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে ‘ভারত রক্ষা আইন’ করে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেন। এ বছর আগস্ট মাসে কলকাতার পুলিশ কমিশনার চার্চ টেগার্টের ওপর বিপ্লবীদের আক্রমণের অভিযোগে এবং গোপন সংগঠন যুগান্তরের সদস্য দেখিয়ে ১ সেপ্টেম্বর হাজার হাজার রাজবন্দীদের সঙ্গে রেবতীমোহনকেও রাজস্থান থেকে স্বৈরাচারী ব্রিটিশ সরকার গ্রেপ্তার করে। মুক্ত রেবতীর চেয়ে বন্দী রেবতী ছিল আরও কর্মতৎপর। তিনি জেলখানায় বসে বন্দীদের মধ্যে শুরু করলেন বৈপ্লবিক আলোচনা, মতবিনিময় লিপলেট বিতরণ, পত্রিকা প্রকাশ ও পুস্তক রচনা। এতে ব্রিটিশ সরকার আরও ক্ষিপ্ত হলেন। তার এ কর্মকাণ্ড বন্ধ করার জন্য এ জেল থেকে ও জেলে দ্রুত স্থানান্তর করতে লাগল। কারাগারের নিষ্ঠুর প্রাচীর কর্মদ্যোগী রেবতীকে কিছুতেই স্তব্ধ করতে পারেনি। বিনা বিচারে আটক করে তাকে ৮ বছর জেলখানায় বন্দী করে রাখে। বন্দী থেকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে তিনি মার্কসবাদের মূল সাহিত্যগুলো পড়তে শুরু করলেন এবং কমিনিস্ট মতবাদ গ্রহণ করেন। স্থির করলেন জীবনে কোন দিন মুক্তি পেলে ভারতীয় কমিনিস্ট পার্টিতে যোগ দিবেন। রাজপুতনার দেওলী কারগার থেকে ২১ জুলাই ১৯৩৮ সালে অসুস্থ অবস্থায় তিনি মুক্তি পেলেন। কথিত আছে সিউরি জেলখানায় বন্দী অবস্থায় তার জ্বর হলে ব্রিটিশ বেনিয়ারা চিকিৎসার নামে তার দেহে কুষ্টরোগের জীবাণু ঠুকিয়ে দিয়েছিল। কুষ্ট রোগ নিয়ে মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কমরেড মুজাফফর আহামদের সঙ্গে দেখা করে সর্ব ভারতীয় কমিনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। ভারতে কমিনিস্ট পার্টি তখন একটি বেআইনি প্রতিষ্ঠান ছিল। কমিনিস্ট পার্টিতে কাজ করার সময় ভারতের বঞ্চিত, শোষিত কৃষকদের প্রতি তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে হুগলি জেলায় বড়া নামক স্থানে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় গবেষণা ও তথ্যবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে তিনি মূল্যবান প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন। প্রবন্ধটি পরে ‘ভারতের কৃষকের সংগ্রাম ও আন্দোলন’ নাম দিয়ে পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়। মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘কৃষক ও জমিদার’ বইটি প্রকাশ করেন। জেলখানায় বন্দী অবস্থায় ভূমি ব্যবস্থাপনার ওপর প্রকাশিত সেটেলমেন্ট রিপোর্ট এবং গেজেটিয়ার সংগ্রহ করে পাঠ করেন এবং এ বিষয়ে যথেষ্ট পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ১৯৩৮ সালে ৫ নভেম্বর বাংলার সরকার স্যার ফ্রানসিস ফ্লাউডের সভাপতিত্বে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কারের পক্ষে ল্যান্ড রেভিনিউ কমিশন গঠন করেন। এই কমিশনের ৬২টি পৃষ্ঠার মেমোরেন্ডামের অন্যতম প্রণেতা ছিলেন রেবতী বর্মণ। ফ্লাউড কমিশনের সদস্য ছিলেন ব্রিটিশ আইসিএস মাইকেল কেরিট। রেবতী এই কমিশনে কাজ করার সময় মাইকেলের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে। ১৯৪৬ সালে মাইকেল দেশে ফিরে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন।
শ্রমিকের অধিকার আন্দোলনেও রেবতীমোহন সোচ্চার ছিলেন। ঢাকেশ্বরী কটন মিলের ও বেলঘরিয়ার শ্রমিকদের মধ্যে তিনি ছিলেন খুবই জনপ্রিয় নেতা। শ্রমিকদের মধ্যেও তিনি কমিউনিস্ট ভাবধারা গোড়াপত্তন করেছিলেন। ১৯৪০ সালে কলকাতার আশপাশের জেলাগুলি থেকে ব্রিটিশ স্বৈরাচারী সরকার রেবতীমোহনকে বহিষ্কার করে। শরীরে দোরারোগ্য মরণঘাতী কুষ্ঠব্যাধী নিয়ে প্রথমে কিশোরগঞ্জ শহরে কিছুদিন অবস্থান করেন। পরে শিমুলকান্দি তার নিজের গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। বাড়ির দালান কোঠা সংস্কার করে অকৃতদ্বার রেবতী বর্মণ বড় ভাই মনমোহনের পরিবারের সঙ্গে বসবাস শুরু করলেন। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তিনি দীর্ঘ ১০ বছর এ বাড়িতেই অবস্থান করেছিলেন। তার ‘সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ’ বইটি রচনার সময় তথ্য সংগ্রহের জন্য মাঝে অল্পদিনের জন্য তিনি কলকাতায় অবস্থায় করেন। ১৯৪৬ সালে একদিন অত্যন্ত গোপনে এক ব্যক্তি রেবতীদের বাড়িতে এসেছিলেন। তার ভাতিজারা শুধু ওইটুকু জেনেছিলেন তিনি একজন মুসলিম কাকাবাবু। এই কাকা বাবুই কমরেড মোজাফ্ফর আহমেদ। রেবতীমোহন নিভৃত পল্লীতে থেকে সমগ্র ভারতবর্ষের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে লাগলেন। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই শিমুলকান্দি হয়ে উঠল রাজনৈতিক নেতাদের মিলনমেলা। তিনি ভুলেই যেতেন কুষ্ঠ রোগের কথা এবং দুঃসহ যন্ত্রণার কথা। ১৯৪৬ সালে আইন পরিষদ নির্বাচনে ময়মনসিংহের কমিনিস্ট পার্টির প্রার্থী হয়ে ছিলেন প্রখ্যাত কৃষক নেতা মনিসিং। মনিসিং কৃষক নেতা নগেন সরকার, হরিবর্মণ, নিবারণ পন্ডিত ও অন্যান্য নেতাদের নিয়ে জনসভা করার জন্য রেবতীদের বাড়িতে এসেছিলেন। নেতারা স্টেশনে এসে পৌঁছলে ভৈরবের নেত্রীবৃন্দ লাল ঝান্ডা কাঁদে করে মনিসিংকে সঙ্গে নিয়ে মিছিল করে শিমুলকান্দিতে এসে পৌঁছায়। পরদিন রেবতীমোহনের সভাপতিত্বে যে সভা হয়েছিল তাতে ৫/৬ হাজার লোকের সমাবেশ ঘটেছিল। অনুষ্ঠান চলার সময় মুসলিম লীগের নেতৃত্বে হাজার তিনেক মানুষ লাঠি রামদা নিয়ে আক্রমণ করতে আসলে সভার মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। সভাপতির আসনে থেকে সবাইকে তিনি শান্ত থাকার জন্য বিনীত অনুরোধ করলেন। উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে স্লোগান দিলেন ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ ‘জাল যার জলা তার’। রেবতী দৃপ্ত কণ্ঠে কৃষকদের অধিকার ও বঞ্চনার কথা ব্যক্ত করলেন। করুণ কণ্ঠে কিশোরগঞ্জের নিবারণ পন্ডিত গাইলেন জন যুদ্ধের গান ও গণসঙ্গীত। স্তম্ভিত হয়ে পড়ল আক্রমণকারীরা। আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য যারা সংগ্রাম করছে তাদের কিনা আমরা মারতে এসেছি।
মন্বন্তরের সময় দুর্ভিক্ষপিড়ীত নিরণ্ন মানুষের জন্য রেবতীদের বাড়িতে নোঙ্গর খানা খোলা হয়েছিল। সেখানে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে অনাহারী মানুষদের প্রতিদিন খাওয়াতেন।
ক্রমে রেবতীমোহনের শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগলো। শরীরের অধিকাংশ স্থান থেকে মাংস খসে পড়ছে। তিনি সমাজ এবং পরিবারের একজন নিষিদ্ধ মানুষে পরিণত হলেন। সহজে কেউ তার কাছে আসতো না। কিন্তু এই পরোপকারী মানবতাবাদী মনীষী বসে রইলেন না। ঘরে বেড়া দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে থেকে এলাকার মেধাবী ছাত্রদের পড়ানোর মহৎ কাজটি শুরু করলেন। এই প্রবন্ধ লেখার পূর্বে আমি অনেক কষ্ট করে তার জীবিত ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। কথা বলেছিলাম এই মহান বিপ্লবী সম্পর্কে। বয়সের ভারে প্রবীণ হলেও রেবতীর প্রিয় শিক্ষার্থীদের স্মৃতি এখনও জাগ্রত এবং দ্বীপ্তিমান। রেবতীমোহনের প্রিয় ছাত্র যিনি দেহরক্ষী নামে পরিচিত ডা. উছমানি গণি ছিলেন তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। গণি সাহেব ও ভারতের বেলঘর থেকে পড়তে আসা বিএ ক্লাসের আরেক ছাত্রী লিলিদে তার প্রিয় শিক্ষককে নিবিড়ভাবে সেবা-যতœ করতেন।
ভারত থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশ বিভাজিত হয়। উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়। নতুন করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছড়িয়ে পড়ে। ধর্মীয় কারণে অভিগমনের (গরম ৎধঃরড়হ) জন্য রেবতীর পরিবারও শিমুলকান্দি ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি জমায়। ১৯৪৮ সালে তার পরিবারের সঙ্গে রেবতীও কলকাতায় এসেছিলেন। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তিনি আবারও শিমুলকান্দিতে চলে আসেন। রাজনৈতিক চাপ, ভয়াবহ অসুস্থতা, পারিবারিক বিচ্ছেদ বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা মর্মাহত হয়ে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি চিরদিনের জন্য দেশ ছাড়তে। দেহরক্ষী দীন দয়াল এবং ছাত্র উছমান গণিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ১৯৫১ সালে মাতৃভূমির সব বাঁধন ছিন্ন করে চিরদিনের জন্য আগরতলায় চলে যান। সেখানে একটি টিলার উপর খড়ের ছাল দিয়ে নির্মাণ করেন এক ছোট্ট কুটির। সেখানেও ভারতবর্ষের জাঁদরেল কমিনিস্ট নেতারা তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করত। মৃত্যুর ঠিক আগমুহূর্তে কমরেড মোজাফ্ফর আহমেদ তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তখন তার শারীরিক অবস্থা এতই খারাপ যে, তিনি আর শরীরের ভার বহন করতে পারছিলেন না। শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে তার মাংস খসে পড়েছিল। তবু তিনি হাতের সঙ্গে দড়ি দিয়ে কলম বেঁধে লেখা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সে লেখাগুলি উদ্ধার হয়নি। ত্রিপুরার বর্মণ টিলায় মরণঘাতি কুষ্ঠের আক্রমণে ভারতের অবিসংবাদিত মানবতাবাদী নেতা ১৯৫২ সালে ৬ মে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে একান্ত নিঃসঙ্গ পরিবেশে দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুর খবর তার আত্মীয়স্বজন পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছিল। শিলিগুড়ির সন্নিকটে হাতি ঘিসায় অটল টি এস্টেট থেকে। শিমুলকান্দিতে এই মহান নেতার স্মৃতির উদ্দেশ্যে ২০০৬ সালে জেলা পরিষদের উদ্যোগে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন।
[লেখক : অধ্যাপক, ভৈরব হাজী আসমত কলেজ]
একটি দৃশ্যপট মিডিয়া লিঃ
Leave a Reply