নিজস্ব প্রতিবেদক
আজ ২০ মার্চ, সোমবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সহচর, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, দেশের অহিংস রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ, বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি, প্রয়াত আলহাজ্ব মো. জিল্লুর রহমানের ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী ।
তিনি ১৯২৯ সালের ৯ মার্চ বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার ভৈরবপুর গ্রামের বলাকী মোল্লার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সাত মাসের মাথায় তাঁর মা বাচ্চু বিবি মারা যান। আর নয় বছর বয়সে হারান বাবা, স্বনামধন্য আইনজীবী অবিভক্ত ময়মনসিংহ লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান ও জেলা বোর্ডের সদস্য মেহের আলীকে।
অনাথ ও বেদনবিধুর শৈশবে জিল্লর রহমান বেড়ে উঠেন দাদা হাজী মোজ্বাফর মুন্সী মোল্লা ও নানা-নানির আশ্রয়ে। তার নানার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈতাতলা এলাকায়। তিঁনি বাড়ির পাশের ভৈরবপুর আদশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। ১৯৪১ সালে তিঁনি ভৈরব কে.বি পাইলট মডেল হাই স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিঁনি ১৯৪৫ সালে ভৈরব কেবি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমান ঢাকা কলেজ) থেকে আইএ পাশ করেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৪ সালে এমএ পাস করেন। ১৯৫৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জিল্লুর রহমান সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলায় ১৯৫২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এক ছাত্র সমাবেশে জিল্লুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। সেখানেই ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারিতে ফজলুল হক ও ঢাকা হলের পুকুর পাড়ে যে ১১ জন নেতার নেতৃত্বে ২১ ফেব্রুয়ারির ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেখানে জিল্লুর রহমান অন্যতম নেতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
১৯৫৩ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার অপরাধে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন এবং একই সঙ্গে তাঁর মাস্টার্স ডিগ্রী কেড়ে নেয়া হয়। কিন্তু প্রবল আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুনরায় তাঁর মাস্টার্স ডিগ্রী ফিরিয়ে দেয়। তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৬ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। ষাটের দশকে তিনি ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র থাকাকালে সিলেটে গণভোটের কাজ করার সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে আসেন। ১৯৬২ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-র ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণআন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে থেকে তিনি অংশগ্রহণ করেন।৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি ভৈরবের জনগণের কাছে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। সে সময় থেকেই তার জনপ্রিয় তুঙ্গে উঠতে থাকে ভৈরবের মানুষের কাছে। তৎকালীন ভৈরব অঞ্চলের প্রতিটি দেওয়ালে দেওয়ালে তার নাম প্রচার হতে থাকে। সে সময়ে দাঁড়িপাল্লার বিরুদ্ধে নৌকা মার্কা প্রতীক নিয়ে তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন।
১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএলএ) নির্বাচিত হন। মো. জিল্লুর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি মুজিবনগর সরকার পরিচালিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনা এবং জয় বাংলা পত্রিকার প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই সময় দখলদার পাকিস্তান সরকার তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিল করে ২০ বছর কারাদণ্ড প্রদান ও তাঁর সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে।
২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। জিল্লুর রহমান দেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ২০১৩ সালের ২০ মার্চ সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দলীয় সরকার গঠন হলে তিনি স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং সংসদের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও স্বাধীনতার পর তিনি ৩ বার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভানেত্রী এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট দলীয় জনসভায় গ্রেনেড হামলায় আহত এবং ২৪ আগস্ট মৃত্যুবরণকারী শহীদ বেগম আইভি রহমান তাঁর স্ত্রী ছিলেন। তাঁদের একমাত্র পুত্র আলহাজ্ব নাজমুল হাসান পাপন বর্তমানে স্থানীয় সংসদ সদস্য। আলহাজ্ব নাজমুল হাসান পাপন বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিবি) সভাপতি।
জিল্লুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর জন্মভূমি কিশোরগঞ্জের ভৈরবে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
একটি দৃশ্যপট মিডিয়া লিঃ
Leave a Reply